
রাজধানীর বসুন্ধরার পর উত্তরা ও কাঁটাবনে ‘নাশকতার’ কৌশল শেখাতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া-সংক্রান্ত ‘গোপন বৈঠকের’ তথ্য পাওয়া গেছে।
গতকাল শুক্রবার একটি গোয়েন্দা সূত্র সমকালকে জানায়, উত্তরা ও কাঁটাবনের বৈঠকে কারা উপস্থিত ছিলেন, তা জানার চেষ্টা চলছে। বসুন্ধরার বৈঠকে বেশির ভাগ সদস্য ঢাকার বাইরে থেকে এসেছিলেন। দেশের বাইরে থেকে পলাতক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, পুলিশ বা আমলাদের কেউ সহযোগিতা করেছেন কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সূত্রের দাবি, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১২ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকা থেকে যুবলীগ নেতা সোহেল রানা এবং আওয়ামী লীগের নেত্রী শামীমা নাসরিন শম্পাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে দুজনকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে প্রশিক্ষণ দেওয়ার গোপন বৈঠকে মেজর সাদিকুল হক সাদিকের অংশগ্রহণের বিষয় উঠে আসে। তাঁর নির্দেশেই তৃণমূল আওয়ামী লীগ কর্মীদের সংগঠিত করা হয় বলে জানান সোহেল ও শম্পা।
এদিকে, গতকাল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সম্প্রতি একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা-সংক্রান্ত অভিযোগ পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ জুলাই ওই সেনা কর্মকর্তাকে তাঁর নিজ বাসস্থান রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে আটক করে হেফাজতে নেওয়া হয়। ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য ইতোমধ্যে একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। পূর্ণাঙ্গ তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এতে বলা হয়, এ বিষয়ে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করা হচ্ছে। এ ছাড়া তাঁর কর্মস্থল থেকে অনুপস্থিত থাকা-সংক্রান্ত ব্যত্যয়ের বিষয়ে আরেকটি তদন্ত আদালত করা হয়েছে এবং তদন্ত শেষে আদালতের সুপারিশ অনুযায়ী সেনা আইন অনুযায়ী দায় নিরূপণ (কমান্ড রেসপনসিবিলিটি) করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইএসপিআর আরও জানায়, সেনাবাহিনী একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং পেশাদার প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কোনো সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেনাবাহিনী তার সদস্যের মধ্যে পেশাদারিত্ব, শৃঙ্খলা ও সাংবিধানিক দায়িত্ববোধ বজায় রাখার প্রতি সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত
ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠকের রহস্য উদ্ঘাটন ও এর পেছনে জড়িতদের বের করতে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। গতকাল বিকেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ডিএমপির সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি।
পুলিশ জানায়, আওয়ামী লীগ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগসহ অন্য সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গোপন বৈঠকের ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্তে আরও কিছু তথ্য এসেছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কনভেনশন সেন্টার ভাড়া নেওয়া হয় আরএসএফ নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সির নামে। ৮ জুলাই ঘটনার দিন সকাল ১০টার পর থেকে সেন্টারের সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন ব্যবস্থাপক মুজাহিদ। পুলিশ হেফাজতে থাকা মুজাহিদের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে।
এক প্রশ্নের জবাবে তালেবুর রহমান বলেন, ৮ জুলাই বসুন্ধরা এলাকার কে বি কনভেনশন সেন্টারে বৈঠক নিয়ে আমাদের কাছে তথ্য ছিল। এটি ভাড়া নেন শামীমা নাসরিন শম্পা নামে একজন। তিনি বিদেশে লোক পাঠানোর নাম করে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেছেন।
ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সেখানে লোকজন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় ১৩ জুলাই ভাটারা থানায় মামলা হয়। উপকমিশনার তালেবুর রহমান বলেন, ‘ইতোমধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। এ ঘটনার অন্য কোনো দিক আছে কিনা, প্রকৃত রহস্য কী এবং কারা কারা এর পেছনে দায়ী, সেগুলো শিগগির উন্মোচন করা হবে।’
কনভেনশন সেন্টারে বৈঠক ও ৮ আগস্ট ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে নানা ‘হুমকির’ আলোচনা নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে অনেকেই কার্যক্রম চালিয়েছে। তবে আমরা সজাগ রয়েছি।’
ঢাকা মহানগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে দাবি করে তালেবুর রহমান বলেন, বর্তমানে আগস্টকেন্দ্রিক কোনো নিরাপত্তা শঙ্কা দেখছি না। আমরা সব সময় সতর্ক রয়েছি। গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। নিয়মিত কার্যক্রম চলমান এবং যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি ও সক্ষমতা রয়েছে।
বসুন্ধরার বৈঠকের ঘটনায় মামলার এজাহারে বলা হয়, ৮ জুলাই বসুন্ধরার কে বি কনভেনশন সেন্টারে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ গোপন বৈঠকের আয়োজন করে। দিনভর বৈঠকে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা মিলে ৩০০ থেকে ৪০০ জন অংশ নেন। সেখানে তারা সরকারবিরোধী স্লোগান দেন।
এতে আরও বলা হয়, বৈঠকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ পেলে সারাদেশ থেকে ঢাকায় লোক জড়ো, শাহবাগ মোড় দখল করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে শেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিশ্চিত করার মতো পরিকল্পনা করা হয়।
ভাটারা থানার মামলায় পুলিশ যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মেজর সাদিককে জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে।
পাঠকের মতামত